বাঙ্গালীর পোস্ত

 

বং দুনিয়া ওয়েব ডেস্ক- শুনতে পেলাম পোস্তা গিয়ে। সুকুমার রায় হয়ত তার কবিতায় ছেলের নামে একটি আ কার বাড়িয়ে দিলেন। আবার পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায় এক কাঠি এগিয়ে সিনেমা বানালেন পোস্ত। বাঙ্গালীর রসনার এক অণন্য নাম পোস্ত। খাবার পাতে যদি শোনা যায় পোস্ত আলু আছে তাহলে পিড়িটায় আরেকটু জমিয়ে বসা যায়। যাক আমরাও জমিয়ে আজকে সেই পোস্তর নাড়ীর খবর বের করার চেষ্টা করি। ঘটি বাঙ্গালের যতই লড়াই থাকুক না কেন রসনায় পোস্ত কে না চায়?

যাকে আমরা পোস্ত দানা বলি তাহলো এক ধরণের তৈলবীজ যা আফিম থেকে পাওয়া যায়। হাজার হাজার বছর ধরে এ পোস্তর চাষ হয়ে আসছে। ছোট বৃক্কের মত দেখতে। পোস্ত মূলত: খাবারে মশলা হিসাবে ব্যবহার করা হয়।

ইতিহাসের পাতায় পোস্তঃ 

ইতিহাস বইয়ের পাতায় পোস্তকে অবমূল্যায়ন করা হয়নি। খ্রি:পূর্ব ১৫৫০ সালে রচিত ইজিপশিয়ান ইবার্স পেপাইরাস নামের পার্চমেন্টে প্রশান্তিদায়ক হিসাবে পোস্ত দানাকে বলা হয়। ব্রোঞ্জ যুগে মিনোয়ান সভ্যতায় পোস্ত দানার চাষ করা হতো। দুধ, আফিম, মধুর মিশ্রন বাচ্চাদের শান্ত করায় ব্যবহার হতো। মিনোয়ান সভ্যতা তা প্রায় খ্রি: পূর্ব ২৭০০ থেকে ১৪৫০। সুমেরিয়ান সভ্যতায় পোস্তদানা চাষ করা হতো। লোকগাথায়ও পোস্ত দানাকে মূল্যায়ন করা হয়েছে। পোস্তদানা ঘুমের ঔষুধ, প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি এমনকি ধন সম্পদ বাড়াতে সাহায্য করে। লোকজ বিশ্বাসে পোস্তদানাকে অলোকিক শক্তির অধিকারী হিসাবে দেখান হয়েছে। ভারতীয় সভ্যতাতেও আফিম বা পোস্তর মূল পরিচয় ছিল ওষধি হিসাবে। ধন্বন্তরি তাঁর বইয়ে নিদান দিয়েছেন পোস্তকে নিয়ে । সম্রাট আকবর এর কদর বাড়ান রান্নার উপকরণ হিসেবে শোনা যায় সম্রাট আকবরের নির্দেশে বাংলায় বাড়ানো হয় পোস্ত চাষ । মুঘল হেঁশেলে রান্নায় স্বাদ বাড়াতে বা কোনও ঝোল ঘন করতে পোস্তর কদর ছিল বেশ । বিট্রিশরা এসব বিষয়ে তো আরো এক কাঠি উপরে। তার আবিষ্কার করল গাজা। একই সাথে ব্রিটিশরা দেখল চিনে বেআইনি গাঁজার বিশাল বাজার । অতএব টাকা দরকার বিট্রিশরা বাংলা বিহার ওড়িশা জুড়ে ব্যাপক হারে বাড়িয়ে দিল গাঁজা চাষ । বিট্রিশদের আসার পর থেকে গ্রাম বাংলায় অতি দ্রুত বেড়েছিল পোস্ত চাষ । ধান চাষিদের ঘরে হাহাকার । আফিম, গাজার ব্যবসা করে ব্রিটিশদের আঙুল ফুলে কলাগাছ । গাঁজা বাই প্রোডাক্ট হিসেবে পড়ে থাকল প্রচুর পরিমানে ওপিয়াম সিড বা পোস্ত দানা । ফলে বাঙালি রান্নাঘরে আর অভাব থাকল পোস্তর | পোস্ত আর দামী খাবার থাকল না সাধারণ গৃহস্থালী খাবারে পরিণত হল। সাধারণ গৃহস্থ আলুসিদ্ধ-পান্তাভাতে খেত পোস্ত বাটা আর পোস্তর বড়া । শুকনো জায়গায় চাষ হয় বলে বাংলার পশ্চিম অঞ্চলে বেশি চাষ হতো । প্রথমে ব্রিটিশরা তাদের রাজধানী বাংলায় করায়, ইউরোপীয় খাবার যেমন, জুইশ খাবার যেমন কেক-পেস্ট্রি সাজাতেও ব্যবহৃত হতে লাগল পোস্ত । দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গাজা চাষ বন্ধ করা হল। তাই পোস্ত হয়ে গেল মহার্ঘ্য । পোস্তর আভিজাত্য আবার ফিরে এল। কিন্তু পোস্ত অভ্যস্ত বাঙ্গালী কি করবে। চার্বাক বানী মনে রেখেই ঋণ করেও পোস্ত তো খাওয়া লাগবে।

পোস্ত চাষাবাদঃ

পোস্ত যেহেতু আফিমের থেকে পাওয়া যায় এ জন্য এ চাষ নিয়ে রয়েছে মত বিরোধ। আফিম বা গাজার বাই প্রোডাক্ট পোস্ত হওয়ায় সরকারের নিয়ন্ত্রনে কিছু চাষাবাদ হয়ে থাকে। পোস্তদানা খুব ছোট এক মিলিমিটারের কম লম্বা। ৩৩০০ টি পোস্তদানায় মাত্র ১ গ্রাম হয়। সমস্ত বিশ্বের অনেক গুলো দেশেই পোস্তর উৎপাদন হয়ে থাকে। তার মধ্যে ২০১২ সালে চেক প্রজাতন্ত্রেই ২২৬৬৫ মেট্রিক টন পোস্ত দানা উৎপাদিত হয়। চাহিদার দিক থেকে হল্যান্ডের উৎপাদিত স্লেট-ব্লু রঙের পোস্তের চাহিদা সব থেকে বেশি।

পোস্তর পুষ্টিঃ

এত চাহিদা সম্পন্ন পোস্ত দানা পুষ্টি গুনেও কম নয়। পোস্ত দানায় রয়েছ খনিজ, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস এবং পটাশ। এত গুন সম্পন্ন একটি মশলা পোস্ত দানা। রান্নায় মসলা হিসাবে বা বিভিন্ন বেক করা খাবার এমনকি খাবার সাজানোয় পোস্ত দানা ব্যবহার করা হয়।

পেস্ট্রির ভিতরে পোস্তদানা মাখন বা দুধের সাথে ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন দেশের রান্নায় পোস্তকে বিভিন্ন ভাবে ব্যাবহার করা হয়। প্রচুর পুষ্টি গুণ সম্পন্ন এই পোস্ত দানা গর্ভবতী মহিলা এবং নতুন মায়েদের খাবারের পরামর্শ দেওয়া হয়। ইউরোপীয় রান্নায় দুধে পোস্তদানা মিশিয়ে ঠান্ডা করে খাওয়া হয়। ইহুদীদের রান্নায় পোস্তদানার পুর একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। ভারতীয় রান্নায় খাবারের ঘনত্ব বৃদ্ধি ও সুগন্ধের জন্য পোস্ত দানা ব্যবহার করা হয়।

ভারতীয় আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় পোস্তের ব্যবহার রয়েছে। পোস্তের বানিজ্যিক গুণের সাথে, শিল্প ও চিকিৎসাক্ষেত্রে এর ব্যবহার রয়েছে। পোস্তদানা খুবই পুষ্টিকর।তবে পোস্তদানার অ্যালার্জী সহ কিছু শারীরিক সমস্যাও তৈরি হয়। মরফিনের উপস্থিতি থাকায় সিঙ্গাপুর, তাইওয়ানে পোস্ত বিক্রি নিষিদ্ধ।

পোস্তর খাবারঃ 

বাঙ্গালীর পোস্ত

বাঙ্গালী মাত্রেই আলু পোস্ত নাম জানলেও পোস্তরা হাজারো ব্যবহার রয়েছে। পোস্ত দিয়ে ডিম, পটলের সাথে পোস্ত, ফুলকপির সাথে পোস্ত, ঝিঙ্গের সাথে পোস্ত, পোস্তর বড়া, পনিরের সাথে পোস্ত, পোস্ত বাটা, ঝাল পোস্ত, ঝিঙ্গা আলু পোস্ত, পোস্ত বড়ি চচ্চরি। নিরামিষের সাথে পোস্ত আমিষের সাথে পিছিয়ে নেই। মাছের সাথে পোস্ত, চিকেন পোস্ত। বাঙ্গালীর জাতীয় মাছ সেও পোস্তকে হতাশ করেনি। ইলিশের সাথে পোস্ত। পানির পোকা চিংড়ীও পোস্তকে হতাশ করেনি। বাঙ্গালীর রসনা সমৃদ্ধ ফল আম সে জায়গা করে নিয়েছে পোস্তর সাথে। বিদ্যাসাগরের কই মাছও বাদ যায় নি। পোস্তর রেসিপি করতে গেলে কেউ বাদ দিতে চায় না নারকেলও তেমনি জায়গা করে নিয়েছে।

পোস্তর রেসিপি বলে শেষ করা যাবে না। বাঙ্গালীর এমন অবস্থা কবে যেন বলে না বসে আমার সন্তান থাকে যেন পোস্ত ভাবে। শোনা যায় কোন এক কবি তার কবিতায় লিখেছিলেন, ‘‌মোটা মোটা শাঁখা পরা হাতে মা রাঁধতেন পোস্তর ঝাল। সে কী আহ্লাদ।’‌ পূজোর ঘন্টা আমাদের কড়া নাড়ছে সেই সুসুযোগে চলুন হয়ে যাক পোস্তর কোন একটি পদ।

Mr. Shuva is a News and Content Writer at BongDunia. He has worked with various news agencies all over the world and currently, he is having an important role in our content writing team.

Leave A Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.