বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটি নাম- বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন । বাঙালির মানস ক্যানভাসে যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, তার নাম ও স্মৃতি থাকবে চিরকাল অমলিন । বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনকে ১৯৭৩ সালের ১৫ ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান “বীরশ্রেষ্ঠ” উপাধিতে ভূষিত করা হয় । তাঁকে স্মরণ করে বর্তমানে তার গ্রামের নাম রাখা হয়েছে আমিন নগর । এছাড়াও এই মহান শহীদের পরিবারের দান করা কুড়ি শতক জমির উপরে নির্মাণ করা হয়েছে গ্রন্থাগার এবং সংগ্রহশালা । ভাবতে অবাক লাগে নিশ্চিন্ত জীবন ছেড়ে, পরিবারের ভালোবাসা, তাদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যকে এক পাশে সরিয়ে রেখে, দেশপ্রেমকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিয়েছেন এই সমস্ত বাংলা মায়ের সূর্যসন্তান । এদের অসম সাহসিকতা আর দেশের প্রতি কর্তব্য-এর জন্য আজ বাঙালি তাদের সোনার বাংলাদেশের মাটিতে হেসে খেলে বেড়াচ্ছে । সারা বিশ্বের কাছে গর্বের সাথে বলতে পারছে – ‘আমরা বাঙালি’ ।

বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন ১৯৩৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন । তার পৈতৃক বাড়ি ছিল ফেনী জেলার বেগমগঞ্জ থানার বাঘচাপড়া গ্রামে । পিতার নাম ছিল মোহাম্মদ আজহার পাটোয়ারী এবং মাতা জুলেখা খাতুন । পাড়ার মক্তবে পড়াশোনা শুরু করে পরবর্তীকালে বাঘ চাপড়া প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন । ১৯৫৩ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে জুনিয়র মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন এবং প্রাথমিক প্রশিক্ষণ এর কাছে মালদ্বীপে পাকিস্তানি নৌবাহিনীর কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হন । ১৯৫৮ সালে তার পেশাগত ট্রেনিং শেষ হয় । সফলভাবে কোর্স শেষ করার পর মোহাম্মদ রুহুল আমিন জাহাজের ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার হিসেবে কাজে যোগদান করেন । .১৯৬৬ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ বদলি হয়ে আসেন এবং তিনি চট্টগ্রামে পিএনএস বক্তিয়ার নৌঘাঁটিতে যোগ দেন ।

১৯৭১ সালে সারা বাংলাদেশে আগুন জ্বলছে । দেশের গদ্দার রাজাকার বাহিনীকে সাথে নিয়ে পাক জল্লাদরা অবাধে নরহত্যা, লুণ্ঠন চালাচ্ছে । ঘরে ঘরে মা বোনেরা ধর্ষিতা হচ্ছে । গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে আনন্দ উল্লাস করছে হানাদাররা । প্রিয়জন হারা মানুষের কান্না কেউ যে উপভোগ করতে পারে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না । এরকম পরিস্থিতিতে রুহুল আমিন এর মত মহান দেশ প্রেমিক কিভাবে চুপ করে বসে থাকতে পারে ? চারিদিকে কোণঠাসা বাঙালিরা প্রতিরোধ গড়ে তুলছে । সারা দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ দলে দলে যোগ দিচ্ছে মুক্তিবাহিনীতে । মোহাম্মদ রুহুল আমিনও যোগ দিলেন মুক্তিযুদ্ধে ।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করার পর এপ্রিল মাসে ত্রিপুরা সীমান্ত অতিক্রম করে ২ নম্বর সেক্টরে যোগদান করেন তিনি । এরপর থেকে, টানা সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মোহাম্মদ রুহুল আমিন বেশ কতকগুলি সামনাসামনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন । এরপর সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বাংলাদেশ নৌ বাহিনী গঠন করার । সবথেকে যোগ্য যোদ্ধাদের আহ্বান করা হয় সারা দেশ থেকে । ওই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মধ্যেও প্রাক্তন নৌসেনারা আগরতলায় সংঘটিত হন এবং নৌবাহিনীর প্রাথমিক কাঠামো গঠন করেন । রুহুল আমিন সহ সকলে কলকাতায় আসেন । প্রাথমিক কাঠামো গঠন করার পর ভারত সরকার এই নবগঠিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে উপহার হিসাবে দুটি ট্যাগ বোর্ড । কলকাতার গার্ডেন রিচে এগুলোর সাথে বাফার গান এবং মাইন গড জুড়ে নিয়ে গান বোর্ড এ রুপান্তরিত করা হয় । গান বোর্ড দুটির নামকরণ করা হয় যথাক্রমে পদ্মা ও পলাশ । রুহুল আমিন গান বোর্ড পলাশের ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার হিসেবে দায়িত্ব নেন ।

১৯৭১ সালের ৬ ই ডিসেম্বর মংলা বন্দরে পাকিস্তান নৌ ঘাটি বিএনএস তিতুমীর ঘাঁটি দখল করার জন্য পদ্মা ও পলাশ ভারতের হলদিয়া বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে । সাথে ছিল মিত্রবাহিনীর গানবোট পানভেল । আসার পথে ৪ই ডিসেম্বর সুন্দরবনের কাছে আড়াই বানকিতে ‘চিত্রাঙ্গদা’ এই বহরে যোগদান করে । রাস্তায় কোন প্রকার বাধা বিপত্তি ছাড়াই এই বহর খুলনার হিরণ পয়েন্টে প্রবেশ করে । এখান থেকে প্রদিন ১০ই ডিসেম্বর খুব ভোরে মংলা বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে তারা । চিত্রাঙ্গদা মংলার প্রবেশ পথে অবস্থান নেয় । চিত্রাঙ্গদাকে পাহারায় রেখে সামনে এগিয়ে বাকী গান বোর্ড গুলি । দুপুর বারোটা নাগাদ মংলার খুব কাছাকাছি চলে আসে তারা । কিন্তু হঠাৎ করে আকাশে তিনটি জঙ্গি বিমানের দেখা পাওয়া যায় । পদ্মা ও পলাশ গোলাবর্ষণের অনুমতি চায় । কিন্তু বহরের প্রধান জানান সেগুলি ভারতীয় বিমান । কপালের ফেরে ভুল বোঝাবুঝির কারণে বিমান থেকে পাকিস্তানের নৌ জাহাজ ভেবে পদ্মা ও পলাশ এর উপর বোমা বর্ষণ শুরু হয় । পলাশের কম্যান্ডার সবাইকে গান বোর্ড ত্যাগ করার আদেশ দেন । কিন্তু রুহুল আমিনকে কোনোভাবেই পলাশ থেকে নামাতে রাজি করা যায়নি । তিনি পলাশেই অবস্থান নেন এবং আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকেন পলাশকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য । কিন্তু হায়রে ভাগ্য ! হঠাৎ করে একটা বোমা এসে পড়ে পলাশের উপরে । পলাশের ইঞ্জিনরুম এ আগুন ধরে যায় সাথে সাথে । রুহুল আমিন – এর একটা হাত উড়ে যায় গোলার আঘাতে । শেষ সময় পর্যন্ত চেষ্টা করেও জাহাজটিকে বাঁচাতে পারলেন না তিনি । সবেমাত্র জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ নৌবাহিনী মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । ‘বাংলাদেশের সম্পদ ধ্বংস হয়ে যাবে ‘ ? এই একটা চিন্তাই বাংলার সাহসী সন্তান রুহুল আমিন-এর মাথায় ছিল । নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে জাহাজ বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন তিনি । যখন দেখলেন যে, জাহাজ বাঁচানো আর কোন মতেই সম্ভব নয়, তখন একেবারে শেষ মুহূর্তে, চরমভাবে আহত অবস্থায় জলে ঝাঁপ দেন তিনি । ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে এক হাত দিয়ে সাঁতরে যখন তিনি নদীর তীরে পৌঁছাল তখন সেখানে আড়ালে লুকিয়ে অপেক্ষা করছিল পাকহানাদারদের বিশস্ত রাজাকারের দল । আহত রক্তাক্ত রুহুল আমিনকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে তারা ।

বেশ কয়েকদিন নদীর চরে পড়েছিল এই বীর সন্তানের দেহ । পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার সেখানে তার স্মৃতিসৌধ গঠন করে । তিন কন্যা এবং এক পুত্র রেখে শহীদ হন বাংলার এই বীর সন্তান । বর্তমানে দারিদ্রতার সাথে লড়াই করেই রুহুল আমিনের একমাত্র ছেলে শওকত আলী দিনাতিপাত করছেন । এখন তিনি দিনমজুর এবং পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন রিক্সা চালনাকে । বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন যেখানে মারা গিয়েছেন সেখানে তার নামে সমাধিফলক রয়েছে । কিন্তু বর্তমানে নদীর ভাঙ্গনের ফলে সেগুলি আর কতদিন টিকে থাকবে, সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে ।

Kajal Paul is one of the Co-Founder and writer at BongDunia. He has previously worked with some publishers and also with some organizations. He has completed Graduation on Political Science from Calcutta University and also has experience in News Media Industry.

Leave A Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.