নিত্যদিনের জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় গৃহস্থালির খরচ বাড়ছে। এই পাগলা ঘোড়া কোথায় থামবে, কে থামাবে তা দেখার জন্য অনেক মধ্যবিত্ত মানুষ বাজেটের দিকে চোখ রেখেছিলেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে চাইল। তিনি ভেবেছিলেন, নির্বাচনের পর প্রথম বাজেটে জনগণের সন্তুষ্টির কথা মাথায় রেখে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কমানোর ব্যবস্থা নেবেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে নিম্ন মধ্যবিত্তদের হতাশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।

তিনি শুধু বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১০ শতাংশ থেকে ৬.৫ শতাংশে নামিয়ে আনার আশা প্রকাশ করেছেন; কিন্তু কোনো রূপরেখা দেননি। পরিবর্তে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) ঋণের অবস্থার চাপে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর পরিকল্পনার অংশ হিসাবে ভোগ্যপণ্যের উপর ভারী কর আরোপ করেছে। এতে সাধারণ মানুষের পকেট পুড়ে যাবে। জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পাবে।

এসব ব্যয় মেটাতে আয় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। তবে বর্তমানে ব্যয় দেশের মানুষের আয়কে ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, মে মাসে দেশে মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ।

সেখানে মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ। অর্থাৎ আয়ের চেয়ে ব্যয় দুই শতাংশ বেশি।
2024-25 অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, ডলারের অবাস্তব বিনিময় হারের প্রেক্ষাপটে জনগণের প্রকৃত আয় কমে যাওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। আগামী দুই অর্থবছরের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হচ্ছে না। তবে ন্যূনতম আয়করের পরিমাণ আগের মতোই রাখা হয়েছে।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকার করদাতাদের দিতে হবে ৫ হাজার টাকা, অন্যান্য পৌর কর্পোরেশন এলাকার করদাতাদের দিতে হবে ৪ হাজার টাকা এবং অন্যান্য জেলা শহর ও পৌরসভা এলাকার করদাতাদের দিতে হবে ৩ হাজার টাকা।

তবে ধনীদের কাছ থেকে আরও কর আদায়ের পদক্ষেপ মধ্যবিত্তদের কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে। বর্তমানে, ব্যক্তিগত করদাতাদের উপর সর্বোচ্চ করের হার 25 শতাংশ। তা বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে। তবে করদাতাদের হয়রানি কমাতে আয়কর রিটার্ন মূল্যায়নের বিধান বাতিল করা হচ্ছে। এ জন্য বাজেটে আয়কর আইনে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে, উভয় শ্রেণীর করদাতা – ব্যক্তি এবং সংস্থা – কিছুটা স্বস্তি পাবেন।

করমুক্ত জীবনযাত্রার সীমা অপরিবর্তিত রাখার পাশাপাশি, অর্থমন্ত্রী ধনীদের সারচার্জ বা অর্থ মওকুফ করেছেন। এ ছাড়া পরিবেশগত সারচার্জেও কোনো ছাড় দেওয়া হয়নি। ফলে বিত্তবানরা স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাসের সুযোগ পায়।

অনেক মধ্যবিত্তদের চাকরির প্রয়োজনে অফিসে যেতে হয়। এ জন্য কাপড় লন্ড্রিতে পরিষ্কার করা হোক বা ইস্ত্রি করা হোক। বাজেটে ভ্যাটের হারও ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এর মানে কাপড় ধোয়া ও ইস্ত্রি করার খরচ বেড়ে যাবে। অনেকেই বিদেশ ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন। এর জন্য ট্যুর অপারেটরদের সাহায্য নিন। এই সাহায্য পেতে বাড়তি টাকা খরচ করতে হয়। কারণ ট্যুর অপারেটরদের ওপর নতুন ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে।

যান্ত্রিক শহরের কোলাহল এবং শহুরে জীবনের কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে, অনেক মানুষ প্রকৃতির কাছাকাছি তাদের পরিবারের সাথে সময় কাটাতে আগ্রহী। তবে যারা ভ্রমণ করেন তাদের জন্য দুঃসংবাদ রয়েছে। বিনোদন পার্ক ও থিম পার্ক সেবার ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মুসাক) বা ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। আগে এই সেবার ওপর ভ্যাট ছিল ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এখন স্বল্প যাত্রাও অর্থমন্ত্রীর চোখে বিলাসিতা।

বেড়াতে যাওয়ার পর শিশুরা যদি আইসক্রিম, চকলেট বা কোমল পানীয়, বিভিন্ন ধরনের জুস, আমস্তবের দাবি করে, তাহলে আগেই জেনে নিন দাম বাড়বে। জনস্বাস্থ্য ও রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে এসব পণ্যে ভ্যাট যোগ করা হয়েছে।

প্রচণ্ড গরম থেকে বাঁচতে যারা এসি কেনার স্বপ্ন দেখছিলেন, তাদের স্বপ্ন ভেস্তে গেছে। কারণ এসি তৈরিতে ব্যবহৃত কমপ্রেসারসহ অন্যান্য উপকরণ আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া উৎপাদন পর্যায়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। এতে এসির দাম বাড়বে। ফ্রিজের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। রেফ্রিজারেটর কম্প্রেসার আমদানিতে শুল্ক ও ভ্যাট আড়াই শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া জ্বালানি সাশ্রয়ী বাল্ব ও টিউব লাইটের দামও বাড়বে। ফলে পারিবারিক সম্পদ সংগ্রহের খরচ বাড়বে।

আপনি যদি একটি বাড়ি তৈরির পরিকল্পনা করে থাকেন তবে এখনই খরচ বৃদ্ধি বুঝুন। আপনি একটি বাড়ি তৈরি করতে যত বেশি ইট ব্যবহার করবেন, আপনাকে তত বেশি খরচ করতে হবে। প্রতি 1000 পিস ইটের উপর 50 টাকা অতিরিক্ত ভ্যাট ধার্য করা হবে। অবশ্য, অতিরিক্ত টাকা বাঁচাতে ব্যাঙ্কে গেলেও আপনি আশ্বস্ত হতে পারবেন না। সেখানেও আবগারি শুল্ক দিতে হয়।

নিরাপদে থাকার জন্য বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তারক্ষীদের রাখা হয়েছে। এ সেবার ওপর ভ্যাটও ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।

অর্থমন্ত্রী কর আদায়ের জন্য নারীদের মেকআপেও হাত দিয়েছেন। নারীদের সৌন্দর্য পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। হাত, নখ, পায়ের প্রসাধনী, লিপস্টিক, চুলের যত্নের পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক বাড়লে কসমেটিক সামগ্রীর দাম বাড়তে পারে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্দেশনা অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, যন্ত্রপাতি ও নির্মাণ সামগ্রীর আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এ কারণে ক্রমাগত জনজীবনের সঙ্গে জড়িত বিদ্যুতের দাম বাড়তে পারে। এতে পণ্যের উৎপাদন খরচ প্রভাবিত হতে পারে। কর অব্যাহতি কমানোর বোঝা দেশীয় শিল্পের ওপর পড়তে পারে।

যদিও কর সংগ্রহ বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, তবুও কালো টাকা যাদের কাছে আছে তাদের কিছুটা সাদাতে রূপান্তর করার সুযোগ রয়েছে। তবে এর জন্য আগের চেয়ে ৫ শতাংশ বেশি আয়কর দিতে হবে। আগে এই হার ছিল ১০ শতাংশ, এখন তা ১৫ শতাংশ। এই প্রক্রিয়ায় অর্থ বৈধ হয়ে গেলে কোনো সরকারি সংস্থা কোনো ধরনের প্রশ্ন করতে পারবে না।

আপনার যদি দিনরাত বা অবসর সময়ে সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস থাকে তবে তা ত্যাগ করাই ভালো। কারণ সিগারেটের দাম বাড়বে। রাজস্ব আয়ের সহজ উপায় হিসেবে এনবিআর প্রতি অর্থবছরে সিগারেটের দাম বাড়ায়, এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তাই বাজারে সিগারেটের প্যাকের দাম বাড়বে।

বাজেটে কত কিছুর পরিবর্তন হয়েছে? মোবাইল ফোনে এসব বিষয়ে বন্ধু বা আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বললে আগের চেয়ে বেশি টাকা দিতে হবে। বিকল্পভাবে, আপনি যদি ইন্টারনেটের মাধ্যমে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন, তাহলেও আপনি ট্যাক্স ফাঁদে পড়বেন। কারণ মোবাইল ফোনে কথা বলা ও ইন্টারনেট ব্যবহারে ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক যোগ করা হয়েছে। তবে ৩০টি নিত্যপণ্যের সরবরাহ পর্যায়ে উৎস কর ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হচ্ছে। এই মুহূর্তে বাজেটে এটাই সবচেয়ে বড় খবর।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসেন গতকাল কণ্ঠকে বলেন, ‘মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়েছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে আয় বাড়ে না। ফলে টিসিবির লাইন দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। মধ্যবিত্তরাও টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে। এবারের বাজেটে যেভাবে কর বাড়ানো হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষ আরও বেশি সমস্যায় পড়বেন।

Nitya Sundar Jana is one of the Co-Founder and Writer at BongDunia. He has worked with mainstream media for the last 5 years. He has a degree of B.A from the West Bengal State University.

Leave A Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.